বৃহস্পতিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

চিরঞ্জীব রনেশ দাস গুপ্ত

(১৫ জানুয়ারি ১৯১২ - ৪ নভেম্বর, ১৯৯৭) সাহিত্যিক, সাংবাদিক সংগ্রামী, রাজনৈতিক কর্মী ও দেশের স্মরণীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উদীচীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রনেশ দাস গুপ্ত এর ১০১ তম জন্মবাষিকি উপলক্ষে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী  যুক্তরাজ্য সংসদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি I

পিতা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত খ্যাতনামা খেলোয়াড় ছিলেন। কাকা নিবারণ দাশগুপ্ত ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও পেশায় শিক্ষক। আরেক কাকা ছিলেন গান্ধীবাদী স্বদেশী। পারিবারিক পরিমণ্ডল এমন হওয়ার ফলে ছোটবেলা থেকেই দেশ, পরাধীনতা, বৃটিশবিরোধী রাজনীতি ইত্যাদির সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটেছিল এবং পরবর্তী জীবনে এই রাজনৈতিক সচেতনতা তাকে চালনা করেছিল।

১৯২৯ সালের রাঁচির (বিহার) স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে বাঁকুড়ার কলেজে ভর্তি হন। এ সময় অনুশীলন দলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে ও তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বাঁকুড়া কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলে তিনি কলকাতায় এসে সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পুলিশের উৎপাতে লেখাপড়ায় বিঘ্ন হওয়ায় বরিশালে এসে ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন। থাকতেন তার মাতুল সত্যানন্দ দাশের বাড়িতে, ইনি কবি জীবনানন্দ দাশের পিতা। ১৯৩৪ সালে তার পিতা অবসর গ্রহণ করলে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের গাউরদিয়া গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে সবাই বসবাস করতে শুরু করেন, পরে ওই গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। তখন সবাই ঢাকা শহরে চলে আসেন এবং সংসার চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে রণেশ দাশগুপ্তকে সাংবাদিকতার চাকরি নিতে হয়।

বিখ্যাত পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’য় সাংবাদিক জীবনের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিক জীবনের শুরু। তার লেখক জীবনের শুরু হয় এসময়। সেকালের ঢাকা সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য বিখ্যাত ছিল। তিনি তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ, অচ্যুত গোম্বামী, কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত প্রমুখের বন্ধুত্ব লাভ করেন ও নানা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত হন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাজনৈতিক কারণে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। গোটা পাকিস্তানি আমলে তিনি বহুবার কারাবাস করেছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়ে তিনি জেলে ছিলেন এবং সেখানেই তিনি নাট্যকার মুনীর চৌধুরীকে ‘কবর’ নাটক লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ‘কবর’ নাটকটি তাদের চেষ্টায় কারাগারে মঞ্চস্থ হতে পেরেছিল। কারামুক্তির পর ১৯৫৫ সালে তিনি ‘সংবাদ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার চাকরি গ্রহণ করেন। এ পত্রিকাকে ব্যাপক অর্থে প্রগতির মুখপত্র করে তুলতে তার অবদান ছিল বিরাট। তার সাহিত্যিক খ্যাতি ঘটে এ সময়েই, ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’ (১৯৫৯) নামে একটি বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ রচনার জন্য। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের সময়ে তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়, ১৯৬২ সালে ছাড়া পান, আবার কারারুদ্ধ করা হয় ১৯৬৫ সালে, ছাড়া পান ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সুবাদে। ১৯৬৯ সালে বিপ্লবী কথাশিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সারসহ একঝাঁক তরুণ উদীচী গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন, দেশ স্বাধীন হলে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর কলকাতায় একটি সভায় যোগ দিতে গিয়ে সেখানে থেকে যেতে বাধ্য হন, কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে সামরিক শাসন চালু হয়েছিল। তারপর বাংলাদেশ নানা বিপর্যয় ও উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়। তিনি আর ফিরে আসেননি, স্বেচ্ছানির্বাসিতের জীবন বেছে নিয়েছিলেন I


তিনি কয়েকটি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। ইংরেজি ও উর্দুভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করেছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের অধিকাংশই মননশীল প্রবন্ধ ও অনুবাদের।
====প্রবন্ধগ্রন্থ====
উপন্যাসের শিল্পরূপ(বঙ্গাব্দ ১৩৬৬)

·      শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩)

·      ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রাম(১৯৭২ খ্রি.)

·      আলো দিয়ে আলো জ্বালা(১৯৭০ খ্রি.)

·      আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ

অনুবাদ

·    ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা (১৯৬৯ খ্রি.)

সম্পাদনা

·   জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র

৪৬ বছরের দীর্ঘ পথ চলায় উদীচী



দেশে তখন বিরাজ করছে পাকিস্তানী শাসন। দেশের সিংহভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী মহলের দখলে। ধর্মান্ধতা, কুপমন্ডূকতা গ্রাস করে ফেলেছে গোটা জাতিকে। দেশব্যাপী চলছিল নৈতিকতা বিধ্বংসী কার্যকলাপ।

রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, নজরুলকে করা হয়েছিল দ্বিখন্ডিত, বাঙালিত্বের চেতনাকে করা হয়েছিল নিষ্পেষিত। তখন পাকিস্তানী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছিল বাংলার আপামর সংগ্রামী জনতা। একটি কালজয়ী গণঅভ্যুত্থান উঁকি ঝুঁকি মারছিল। ঠিক সেই সময় দেশের গণসংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক ঔপন্যাসিক সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী (২৯ অক্টোবর, ১৯৬৮)।

উদীচী শুধুই একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়। উদীচী একটি আন্দোলন। উদীচী কেবল সংস্কৃতি চর্চা করে না, গণমানুষের সংস্কৃতি চর্চার পথও নির্দেশ করে। সংস্কৃতির হাতিয়ার ব্যবহার করে জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ঢাকা নগরীর উত্তর প্রান্তের নারিন্দায় শিল্পীকর্মী সাইদুল ইসলামের বাসায় সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, কামরুল আহসান খান, মোস্তফা ওয়াহিদ খান প্রমুখের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় উদীচী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

শিল্পী সংগ্রামী সত্যেন সেনের দীর্ঘ চিন্তার ফসল উদীচী। তিনি খুব সচেতনভাবেই উদীচী নামটি নির্বাচন করেছিলেন। উদীচী অর্থ উত্তর দিক বা ধ্রুবতারার দিক। দিক হারা নাবিকেরা যেমন উত্তর দিকে ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে তাদের নিজ নিজ গন্তব্য স্থির করেন- তেমনি এদেশের সংস্কৃতি তথা গণমানুষের সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সবকিছুই উদীচীকে দেখে তার চলার পথ চিনতে পারবে। এছাড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় আবাসের নাম উদীচী, নামকরণের ক্ষেত্রে এটিও বিবেচিত হলো। উদীচী দেশ ও জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাসমূহকে উপলব্ধি করবে, এ সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করবে, তাদেরকে এই দুঃখ কষ্টের কারণসমূহ মোকাবেলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগাবে এবং আবার তাদেরকে নতুনতর সংগ্রামের জন্য তৈরি করবে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে। উদীচী সমাজ সচেতন, সমাজ পরিবর্তনের নিয়মসমূহ ও কারণসমূহ সম্পর্কে সচেতন। উদীচী কর্মীরা শুধু নিজেরাই সচেতন হওয়া নয়, জনগণকে সচেতন করাকেও কর্তব্য মনে করে। এসব কারণেই উদীচী অপরাপর সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে আলাদা।

উদীচী’র জন্মই হয়েছিল গণসঙ্গীত দিয়ে। সহজভাবে গণমানুষের নিকট যাওয়া যায় একমাত্র গণসঙ্গীতের মাধ্যমেই। তাই এদেশের গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার একাগ্র শক্তি, আদর্শ ও আত্মত্যাগের মহান ঐতিহ্যের গর্বিত বাহক উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এদেশের মেহনতি মানুষের বন্ধু, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সত্যেন সেনের সাবলীল উচ্চারণ-

“মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী
তাই দিয়ে রচি গান
মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব
মানুষের দেয়া প্রাণ।”

গণঅভ্যূত্থানের প্রাক-পর্বে উদীচী’র গান হলো মিছিলের সাহসী যৌবনের প্রণোদনা। ঐ বছরই ঢাকার মঞ্চে প্রথম নাটক করল উদীচী। নাম ‘আলো আসছে’। ঊনসত্তরে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হলেন। আসাদের শার্ট শামসুর রাহমানের কবিতায় হলো পতাকা আর আসাদের জীবনদানকে গান ও নাটকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করল উদীচী। সত্তরের জলোচ্ছ্বাস ও নির্বাচন, দু-স্থানেই উদীচী রাখল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। উদীচী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য” নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। স্টেনগানের গুলির মতোই বেজে উঠলো উদীচী’র কণ্ঠ। স্বাধীনতা উত্তরকালে সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণে উদীচী গণমানুষকে জাগ্রত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করল। জেলায় জেলায় শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত উদীচী সংস্কৃতির অবিনাশী শক্তি নিয়ে যখন কর্মকান্ড পরিচালনা করছে তখন এল চুয়াত্তরের সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। উদীচী দুর্ভিক্ষ পীড়িত বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এল পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট। সপরিবারে নিহত হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্যক্তি মুজিবের সাথে নিহত হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ। জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতাকে। আহত হলো পবিত্র সংবিধান। পরিকল্পিতভাবে ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হলো। রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা নিষিদ্ধ হলো সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের নষ্ট চিন্তার আদেশে।  পিছনে গমন  করা বাংলাদেশ সেনা শাসকদের পরিপূর্ণ পরিচর্যায় এবং বিশ্বদানব সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় প্রসব করল সাম্প্রদায়িকতা। রাজনীতি থেকে শুরু করে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মনোজগৎ পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিস্তৃত করা হলো এই সদ্যজাত সাম্প্রদায়িকতা। এর মধ্যে সুস্থতা যখন নির্বাসিত, বঙ্গবন্ধু যখন নিষিদ্ধ, তখন উদীচী ১৯৭৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর মাহমুদ সেলিম রচিত ‘ইতিহাস কথা কও’ সাহসী গীতিআলেক্ষ্যে উপস্থিত করল বাঙালির মহাকাব্য ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রমনায় ছয় ফুট দীর্ঘ মাইকের স্ট্যান্ডকে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে অনুষ্ঠান করল উদীচী। সেদিন বঙ্গবন্ধুর প্রতীকী উপস্থাপনায় রমনায় সমবেত সকলে নতুন করে দ্রোহে উৎসাহিত হলো।

১৯৭৮ সালে যখন সেনা সরকার যাত্রাকে নিষিদ্ধ করল, মন্দিরে প্রতিমা ভাঙল মৌলবাদীরা, তখন উদীচী সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নামল। ঘোষণা দিল দ্বিতীয় যুদ্ধের। এবারের যুদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে। মাঠে ময়দানে, কলে-কারখানায়, প্রান্তবর্তী জনগোষ্ঠীর অনাদৃত প্রাঙ্গণে উদীচী’র গান, নাটক, কবিতা পরিবেশিত হলো। সেখানে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির বিরুদ্ধে উদীচী’র বীণায় ধ্বনিত হলো রুদ্রের বীণা।

রক্তাক্ত পতাকা, ক্ষত-বিক্ষত সংবিধান, বিবর্ণ মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, বিপন্ন মূল্যবোধ, ভোগবাদের প্রলোভন, পুঁজিবাদের দানবীয় উত্থান, সামরিক স্বৈরাচার, নষ্ট রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা সব  মিলিয়ে আশির দশকের বাংলাদেশ যেন অচেনা প্রান্তর। উদীচী আরো ধ্বংসের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হলো। মানবিক মূল্যবোধের সর্বোদয় জাগৃতি ও বিকাশে শিল্পীর দায়িত্ব থেকে  গৃহীত হলো উদীচী’র বিচিত্র কর্মসূচী। উর্দি শাসনের বিরুদ্ধে উন্মাতাল বাংলাদেশের শত সহ¯্র বিক্ষোভে উদীচী সম্পৃক্ত হলো সর্বাত্মক শক্তিতে। বিশ্ব বেহায়ার খপ্পর থেকে মুক্ত হয়ে জাতি পেল প্রত্যাশিত ’৯১ এর গণতন্ত্র। অথচ মুক্তির মহিমা থেকে বঞ্চিত থাকলো মানুষেরা। বরং নানামাত্রিক সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িকতা স্থান  পেল রাষ্ট্রের নীতিমালায়। চর্চিত হলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ফলে মৌলবাদী চিন্তাচেতনা বিকশিত হলো সর্বত্র। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর করতলগত হলো।

স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর পরই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধ বিরোধী অভিযাত্রা। তিনি একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে গোটা  জাতিকে সংঘটিত করার  চেষ্টা করেন। উদীচী সে আন্দোলনেরও সামনে থেকে গতি সঞ্চার করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি মঞ্চগুলোতে উদীচী’র শিল্পীকর্মীদের পরিবেশিত গান, নাটক ছিল আন্দোলনকারীদের প্রেরণার উৎস। ইতিহাস বিকৃতকারীদের দোসর রাজাকার, যারা লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত লাল-সবুজ পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ে জাতিকে কলঙ্কিত করেছে, স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরে হলেও তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এ সকল আন্দোলনেরই ফসল। বিচারের শেষে রায় নিয়েও যখন টালবাহানা শুরু হয়, তখন দেশের সচেতন তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ আন্দোলন সৃষ্টি করে শাহবাগের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’, যেটির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে উদীচী’র নেতৃবৃন্দ ছিলেন প্রাণভোমরা। পরে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে যাতে প্রাণসঞ্চার করেন উদীচী’র সকল স্তরের কর্মীরা।

কোন জাতিকে  ধ্বংস করতে হলে সর্বাগ্রে বিলীন করতে হয় তার সংস্কৃতিকে। আর এ মর্মবাণী উপলব্ধি করেই প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধকারের শক্তি বারবার আঘাত হেনেছে উদীচী’র উপর। স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে প্রগতির চাকা। তারা ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে  দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা মেরে কেড়ে নিয়েছে ১০ জন শিল্পী কর্মীকে, ২০০৫ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে হত্যা করে নেত্রকোণা উদীচী’র হায়দার ও শেলীসহ মোট ৭ জনকে,  আহত  হয় আরো অনেকে । এখনো বিভিন্ন জায়গায় চলছে নানামুখী হামলা, অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া, চোখ রাঙানি। কিন্তু ধর্মান্ধ মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যতই চক্রান্ত করুক, যত রক্তই ঝরাক না কেন উদীচী’র ধমনী কখনো রক্তশূন্য হবে না। বরং আরো দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠবে দেশীয় দু:শাসন আর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

আজ বিচ্যুতিহীন সংগ্রামী শিল্পীকর্মীর সমাবেশ উদীচী। উদীচী সকল অন্যায়-অবিচার, কুপম-ূকতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং প্রগতির পক্ষে লড়াইয়ে সবার আগে সোচ্চার হয়েছে। এই অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিকামী, স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় গণ-সাংস্কৃতিক সংগঠনটিকে তার এই ঋদ্ধ, সাহসী ও বলিষ্ঠ পথ চলার স্বীকৃত স্বরূপ ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’- এ ভূষিত করা হয়। এই অর্জন শোষিত-নিপীড়িত-বঞ্চিতের, এই অর্জন গণমানুষের। ৪৬ বছরের গৌরবোজ্জ্বল সিঁড়ি বেয়ে মুক্তির নিশানায় এগিয়ে যাবে উদীচী। উদীচীর জন্মের প্রত্যয় শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ আমরাই করবো এবং বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িকই রাখবো- এই হোক আমাদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অঙ্গীকার।

জয় উদীচী। জয় হোক কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতার।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ

অকুতোভয় বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার




১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মাষ্টারদার প্রীতিলতাকে বললেন, পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব তোমাকে নিতে হবে।প্রীতিলতার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাত্রে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল হন।কিন্তু বিপ্লবী প্রীতিলতা গুলিবিদ্ধ হন। এ অবস্থায় ধরা পড়ার আগে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কারণ ধরা পড়লে বিপ্লবীদের অনেক গোপন তথ্য ব্রিটিশ পুলিশের মারের মুখে ফাঁস হয়ে যেতে পারে।

প্রীতিলতা মারা যাওয়ার আগে মায়ের কাছে লিখেছিলেন, ‘মাগো, অমন করে কেঁদোনা! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!

তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?????’

************************************************

কিন্তু দুখের বিষয় আমরা অনেকেই এই মহীয়সী নারী কে চিনি ও না আর চিনলেও তার আত্মত্যাগ এর কথা স্মরণ করি না...!!!!!!!

চে গুয়েভারা : শুধু আইকন নাকি একটা মতবাদ?



ধরা যাক, আমার ঘরে মার্কস বা অ্যাঙ্গেলসের ছবি টাঙানো আছে। অথবা ধরা যাক, লেনিন, স্ট্যালিন বা মাও সে তুং আছে। কী মানে তৈরি হয়?
অথবা ধরা যাক আমার ঘরে বলিভিয়ার জঙ্গলে ঘোরা চে, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে চে অথবা চে'র যে কোনো ছবি টাঙানো আছে। এর মানেই বা কী তৈরি হয়?
কেউ ঘরে লেনিন, মাও বা মার্কসের ছবি টাঙানোর চেষ্টা করেছেন কি না জানি না। মনে মতো একটা পোস্টার সাইজ ছবি পেতে এই ঢাকা শহরে আপনাকে ঘেমে যেতে হবে। যদি না আজিজ মার্কেটের রবিন আহসান সম্প্রতি এদের কোনো পোস্টার না ছেপে থাকে। কিন্তু চের ছবি খুঁজুন। আপনি আমেরিকায় থাকেন, আর ব্রিটেনে, ঢাকা কি বরিশালে চে'র ছবি সহজেই পাবেন। সে ছবি অনায়াসে বাঁধিয়ে ঘরের দেয়ালে এঁটে দিতে পারেন।
ধরা যাক, আপনার বাড়ি কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ বা রাজশাহী। আপনার দেয়ালে চে'র ছবি। কেউ কোনো সন্দেহ করবে? আপনি যে মতবাদে বিশ্বাসী তা নিয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ তৈরি হবে? কেউ আপনার দ্বারা আক্রন্ত বোধ করবে? উত্তর না বাচক হবে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু দেয়ালে মাও সে তুংয়ের ছবি টাঙিয়ে দেখুন। আপনি নিমেষে কত মানুষের সন্দেহ, ভীতি আর বিরোধিতার মুখে পড়েছেন।
কারো ছবি টাঙানোর অর্থ তাহলে তৈরি হয়? ঘরে ঘরে, দেয়ালে দেয়ালে রাজনীতি চলে। মণীষা কৈরালা, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, ঐশ্বরিয়া রাই, কার্ল মার্কস, অনুকুল ঠাকুর, লেনিন, মাও সে তুং, চে গুয়েভারা যাকেই বেছে নেন। একটা অর্থ তৈরি হবে। সেটা কী?
চে গুয়েভারার জন্মদিন উপলক্ষে ব্লগে বেশ কয়েকটি পোস্ট হয়েছে। পারভেজ চৌধুরী পাঁচ বা ততোধিক পোস্ট দিয়েছেন। সুন্দর একটি লেখা দিয়েছেন ফারহান দাউদ। লেখাগুলো আমাকে একটা ভাবনায় ফেলে দিলো। দেখলাম, ব্লগে যেখানে মার্কসবাদের বিরোধিতা খুব চালু ব্যাপার সেখানে চে'কে নিয়ে এতো লেখা কারো বিরক্তি বা বিরোধিতা তৈরি করতে পারলো না। তাহলে বিপ্লবী চে'র ইমেজ বিপ্লবের বদলে আমাদের সামনে অন্য কোনো ইমেজে হাজির হয়েছেন? তিনি কি এখন যথেষ্ট বিপ্লবী নন? প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘাটানোর যথেষ্ট ক্ষমতা তার নেই?
আজিজ মার্কেটে হোসিয়ারি শিল্প বিকাশের সুফল হিসাবে চে'র ছবি কত সহজেই না আমাদের বুকে পিঠে ঠাঁই করে নিয়েছে। কোর্ট পিন সহ নানা সুভ্যেনিরে চে ভাল আইটেম। চে ক্যাপ, চে ক্যাফে, চে শার্ট, চে পাইপ। কত কিছু। মার্কিন সমাজে যেখানে মার্কসবাদ মোটামুটি নিষিদ্ধ, কিউবা শত্রু দেশ, ফিদেল শত্রু ব্যক্তি সেখানেও চে তরুণদের মধ্যে বড় আইকন। সমাজের কর্তারা চে ইমেজ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত কি না বোঝা যায় না। কিন্তু মাও সে তুং বা লেনিন চে'র জায়গা নিয়ে কী হতো? একটু ভাবা দরকার।
আমি কি কোথাও ভুল করছি? যে প্রাকটিসিং মার্কসিস্ট। লাতিন আমেরিকার জনগণের আন্দোলনে তার বড় ভূমিকা। চে'র প্রথম জীবনের মোটর সাইকেল ডায়েরিজ আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল। বীরত্ব, সাহস আর কষ্টে একাকার হয়ে তার শেষ জীবন আমাকে গভীরভাবে তাড়িত করেছিল। চে' যতদিন দিন বেঁচেছিলেন ততোদিন সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দালালদের শত্রু ছিলেন। তাকে হত্যা না করা পর্যন্ত শত্রুরা থামেনি। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি শেষদিন পর্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। তাহলে, এখন সাম্রাজ্যবাদ তাকে নিয়ে ভীত নয় কেন?
চে কি একজন সক্রিয় মার্কসবাদী নাকি একটি মতবাদের প্রবক্তা?
চে কি বাস্তবতাবাদী বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে নাকি রোমান্টিসিস্ট করে তোলে?
চে কি নির্বিবাদী মার্কসিস্ট ইমেজ তৈরি করে?
চের ইমেজ কি সাম্রাজ্যবাদীরা নতুন করে তৈরি করেছে?
চে কেন মার্কস-বিরোধীদের মধ্যেও সমান জনপ্রিয়?
চে কে ভালোবাসতে কি মতবাদ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না?
চে কি একটা স্টাইল?
চে কে তাহলে?


কার্টেসিঃ "মাহবুব মোর্শেদ"

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ



হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ (ফেব্রুয়ারি ১, ১৯৩০) বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধান, এককালীন প্রধান সামরিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি। তিনি জাতীয় পার্টি নামক রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বর্তমানে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) উপদলের নেতা। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসন হতে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচিত সরকারের অধীনে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন কালে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং সামরিক শাসন জারীর মাধ্যমে দেশ শাসন করেন। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুন:প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ঘোষণা করে তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে সংসদীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। এই নির্বাচনে তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির ভোটপ্রার্থী হিসাবে অংশ গ্রহণ করেন এবং পরে ৫ (পাঁচ) বৎসরের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে গণবিক্ষোভের চাপে এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনের অভাবে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

জন্ম ও শৈশব

ফেব্রুয়ারি ১, ১৯৩০ তারিখে তিনি রংপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।[২] তিনি রংপুর জেলায় শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এরশাদ

১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬০ - ১৯৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কেন্দ্রে অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি কোয়েটার স্টাফ কলেজ থেকে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি শিয়ালকোটে ৫৪ ব্রিগেডের মেজর ছিলেন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯ - ১৯৭০ সালে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর কমান্ড্যান্ট ও ১৯৭১ - ১৯৭২ সালে ৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর কমান্ড্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় এরশাদ ছুটিতে রংপুর ছিলেন। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে তিনি পাকিস্তান চলে যান[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]। পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া বাঙালিরা যখন ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসে তখন তিনিও প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর সময় আগ্রা ক্যান্টনমেন্টে স্টাফ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এরশাদ

পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর ১৯৭৩ সালে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অ্যাডজুটান্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে তিনি কর্নেল ও ১৯৭৫ সালের জুন মাসে সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালের ২৪ অগাস্ট ভারতে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান ও Deputy Chief of Army Staff হিসেবে নিয়োগ পান। ১৫ অগাস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের পর এরশাদ বাংলাদেশের দিল্লি মিশনের মাধ্যমে দেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা জানিয়ে বার্তা পাঠান।[৩]
রাষ্ট্রপতি এরশাদ

৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর, এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ হয়ে পড়ে। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল নাগাদ তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ঐ দিন তিনি দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে নিজের অধিকারে নেন। এরশাদ দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে যদিও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এই নির্বাচন বয়কট করে। সাধারণ নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই সংসদ বাতিল করেন। ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচন সকল দল বয়কট করে। এরশাদের স্বৈরাচারের বিরূদ্ধে দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে সকল বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ১৯৮৬

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন , ১৯৮৬ (অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ ১৫ অক্টোবর,১৯৮৬) জয়লাভ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এ নির্বাচনে ১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। বাছাই –এ কোন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাদ না পড়ায় বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ জন। ৪জন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ১২ জন ছিল।

১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ১২জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেনঃ ১। জনাব অলিউল ইসলাম চৌধুরী (সুক্কু মিয়া) ২। আলহাজ্ব মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী ৩। আলহাজ্ব মেজর (অব) আফসার উদ্দিন ৪। জনাব মুহাম্মদ আনছার আলী ৫। জনাব মোহাম্মদুল্লাহ (হাফেজ্জী হুজুর) ৬। জনাব মোহাম্মদ খলিলুর রহমান মজুমদার ৭। জনাব মোঃ আব্দুস সামাদ ৮। জনাব মোঃ জহির খান ৯। লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) সৈয়দ ফারুক রহমান ১০। সৈয়দ মুনিরুল হুদা চৌধুরী ১১। স্কোঃ লিঃ (অবঃ) মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী ১২। জনাব হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ

[৪]
নব্বইয়ের পরে এরশাদ

ক্ষমতা হারানোর পর এরশাদ গ্রেফতার হন এবং ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না-আসা পর্যন্ত কারারূদ্ধ থাকেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি কারাগার থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। বি.এন.পি সরকার তার বিরুদ্ধে কয়েকটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ছয় বছর আবরুদ্ধ থাকার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার মধ্যে মূল ধারার তিনি চেয়ারম্যান।


তথ্যসূত্র

জাতীয় পার্টির ওয়েবসাইট
বঙ্গভবনের ওয়েবসাইট
Ahmed, Fakhruddin (1994)। Critical times, memoirs of a South Asian diplomat (1st সংস্করণ)। University Press, Dhaka। আইএসবিএন 9840512293।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী




বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর একটি শাখা। এই বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনা ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়। বর্তমানে এই বাহিনীর সামর্থ্য প্রায় ৩০০,০০০ সদস্য।

ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য সেনাবাহিনীর মতো ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আদলে গঠিত হয়েছে এই বাহিনী । অবশ্য এই বাহিনী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কৌশলগত পরিকল্পনা কার্যপ্রণালী, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এবং নন-কমিশন্ড অফিসার প্রশিক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে৷ এটি গোলন্দাজ, সাঁজোয়া ও পদাতিক ইউনিট দ্বারা সজ্জিত৷

অধিকন্তু এই বাহিনী, শান্তি-রক্ষী বাহিনী হিসাবে তার সামর্থ্য উন্নত করতে উৎসাহী এবং সেই লক্ষে মার্কিন বাহিনীর সাথে একযোগে কাজ করছে৷

গঠন/প্রতিষ্ঠা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর বাঙালি সৈন্য ও অফিসার এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যান্য অংশ হতে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী(অস্থায়ী) তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন৷ ঐ ভাষণে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবকাঠামো গঠনের কথা উল্লেখ করে এম. এ. জি. ওসমানীকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা দেন৷[১] উল্লেখ্য যে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারী ও সরকার গঠন করা হয় এবং পরবর্তীকালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার, ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। ওসমানীর নির্দেশনা অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে এক একজন সেনাবাহিনীর অফিসারকে নিয়োগ দেয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে সমন্বয়সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা - প্রভৃতি কাজ সাফল্যের সাথে পালন করেন ওসমানী। ১২ এপ্রিল থেকে এম. এ. জি. ওসমানী মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷ রণনীতির কৌশল হিসেবে প্রথমেই তিনি সমগ্র বাংলাদেশকে ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন এবং বিচক্ষণতার সাথে সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন৷ এই বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের জন্য নিয়জিত অংশকে বলা হতো গণবাহিনী যা সাধারণ জনগণ হতে বাছাইকৃত লোকবল নিয়ে গঠিত হয়। এবং নিয়মিত যুদ্ধের জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ইত্যাদি বাহিনীর লোকবল নিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনী গোড়ে তোলা হয়। এই নিয়মিত বাহিনীর জন্য তিনটি ব্রিগেড গঠন করা হয়। সেগুলো হল:

জেড ফোর্স - অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান এবং এটি গঠিত হয়েছিল ১ম, ৩য় এবং ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুলাই।
কে ফোর্স - অধিনায়ক ছিলেন খালেদ মোশাররফ এবং এটি গঠিত হয়েছিল ৪র্থ, ৯ম এবং ১০ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে আগস্ট।
এস ফোর্স - অধিনায়ক ছিলেন মেজর সফিউল্লাহ এবং এটি গঠিত হয়েছিল ২য় এবং ১১শ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর।

ইথিওপিয়ার সুরি জাতির নিষ্ঠুর সৌন্দর্য চেতনা




আফ্রিকার দরিদ্র দেশ ইথিওপিয়া। সেখানকার সুরি জাতির মধ্যে প্রচলিত অদ্ভূত ও নিষ্ঠুর এক সৌন্দর্য চেতনা। বয়ঃসন্ধিকালে এরা এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খুব জোরে মেয়েদের বেশিরভাগ দাঁত ভেঙে দেয়। রক্ত ভেসে যাওয়া অবস্থাতেই এরপর ক্রিকেট ব্যাটের মতো দেখতে একটা জিনিস মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়।

দাঁত ভেঙে তার মধ্যে ডিস্ক (ব্যাট) ঢুকিয়ে নিচের অংশের ঠোঁট তার মধ্যে জড়িয়ে সুন্দর হওয়ার এক রীতি সেখানে চালু আছে। প্রচণ্ড ব্যথা লাগলেও মোটা অঙ্কের পণ পাওয়ার জন্য মেয়েদের এটা করতেই হয়।

একে বলা হয় লিপ প্লেট। যে মেয়ের লিপ প্লেট যত বড় হবে, বিয়েতে তার মা-বাবা তত পণ পাবেন। পণ হিসেবে মেলে গরু। সেই লোভে মেয়ের অসহ্য যন্ত্রণাতেও মা-বাবা বেশ খুশিই হন। এই জাতির ছেলেদের অবশ্য এতটা কষ্ট করতে হয় না। শরীরে ছুঁচের মাধ্যমে রঙ মাখলেই বিবাহযোগ্য হয়ে যায় ছেলেরা। আর মেয়েদের সহ্য করতে হয় অসহ্য যন্ত্রণা, বদলে মেলে লিপ প্লেট আর পণ।

ডেইলি মেইলে গতকাল ইথিওপিয়ার সুরি উপজাতির এমন খবর ও ছবি প্রকাশ পাওয়ার পর সাইবার জগতে তর্ক শুরু হয়েছে। ফেসবুক থেকে টুইটার, ইনস্টাগ্রামে এই ছবি দেদারছে শেয়ার হচ্ছে। সঙ্গে প্রতিবাদও হচ্ছে।