শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বাংলাদেশ


উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাংলাদেশ  দক্ষিণ এশিয়ার একটি জনবহুল রাষ্ট্র যার আনুষ্ঠানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাবসানে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামে যে দেশটি সৃষ্টি হয়েছিলো, তার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ঘটেছে দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ; এছাড়াও প্রলম্বিত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও পুনঃপৌনিক সামরিক অভ্যুত্থান এদেশের রাজনৈতিক সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বারংবার ব্যাহত করেছে। গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি বর্তমান। সকল প্রতিকূলতা সত্বেও গত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রগতি ও সমৃদ্ধি সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম যদিও আয়তনের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম; ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর নবম। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলেরও কম এই ক্ষুদ্রায়তন দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৫.৫৯ কোটির বেশী অর্থাৎ প্রতি বর্গমাইলে জনবসতি ২৪৯৭ জন।

জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা; শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ১১,৯৮,৯২৩ কোটি টাকা (চলতি বাজারমূল্যে) যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বৃদ্ধি লাভ করে ১৩,৫০,৯২০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে জনগণের মাথাপিছু বার্ষিক আয় পূর্ববর্তী বৎসরের ১,০৪৪ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১,১৯০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে মর্মে সরকারী প্রাক্কলন করা হয়েছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৯২,৫১০ টাকা।[৭] দারিদ্রের হার ২৬.২০ শতাংশ, অতিদরিদ্র মানু্ষের সংখ্যা ১১.৯০ শতাংশ, এবং বার্ষিক দারিদ্র হ্রাসের হার ১.৫ শতাংশ। এই উন্নয়নশীল দেশটি প্রায় দুই দশক যাবৎ বার্ষিক ৫ থেকে ৬.২ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অর্জনপূর্বক "পরবর্তী একাদশ" অর্থনীতিসমূহের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরের পরিবর্ধন বাংলাদেশের এই উন্নতির চালিকাশক্তিরূপে কাজ করছে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে কাজ করেছে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ত্বরিৎ বিকাশ এবং একটি সক্ষম ও সক্রিয় উদ্যোক্তা শ্রেণীর আর্বিভাব। বাংলাদেশের রপ্তানীমুখী পোশাক শিল্প সারা বিশ্বে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। জনশক্তি রপ্তানীও দেশটির অন্যতম অর্থনৈতিক হাতিয়ার।

বাংলাদেশের বর্তমান সীমারেখা নির্ধারিত হয় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগের সময়, নবগঠিত দেশ পাকিস্তানের পূর্ব অংশ (পূর্ব পাকিস্তান) হিসেবে। দেশটির উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম সীমানায় ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব সীমানায় মায়ানমার; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।] উল্লেখযোগ্য, বাংলাদেশ ও ভারতীয় অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ একত্রে একটি অবিচ্ছিন্ন বাংলাভাষী অঞ্চল গঠন করে যার ঐতিহাসিক নাম “বঙ্গ” বা “বাংলা”। এর পূর্বাংশ বা পূর্ব বাংলা ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ নামীয় পৃথক একটি আধুনিক জাতিরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের উর্বর অববাহিকায় অবস্থিত এই দেশটিতে প্রায় প্রতি বছর মৌসুমী বন্যা হয়; আর ঘূর্ণিঝড়ও খুব সাধারণ ঘটনা। নিম্ন আয়ের এই দেশটির প্রধান সমস্যা পরিব্যাপ্ত দারিদ্র গত দুই দশকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে দ্রুত, জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সফলতা। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানব সম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।[৮], তবে বাংলাদেশে এখনো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে যার মধ্যে রয়েছে পরিব্যাপ্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে তলিয়ে যাবার শঙ্কা। এছাড়া একটি সর্বগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার রূপ নিয়ে নতুন ভাবে সামাজিক বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে।
 
এদেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কবিমসটেক-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এছাড়া দেশটি জাতিসংঘ, ডব্লিউটিও, ডব্লিউসিও, ওআইসি, ডি-৮, এশিয়ান রিজিওনাল ফোরাম, এশিয়ান কো-অপারেশান ডায়ালগ,এশিয়া ইয়োরোপ মিটিং, ইন্ডিয়ান ওশ্যান রিম এসোসিয়েশান, ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংঘের সক্রিয় সদস্য।


বাংলা ভাষা

         বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য আন্দোলনকারীদের স্মরণে নির্মিত ঢাকা-র শহীদ মিনার

 বাংলা ভাষাটি দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বে অবস্থিত বঙ্গ নামক ভৌগোলিক অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা, এই অঞ্চলটি বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গঠিত। এছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও বাংলা ভাষাতে কথা বলে। পালিপ্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে, এবং পরে গিয়ে সংস্কৃতের প্রভাব রয়েছে। বাংলা ভাষাটি প্রায় ২৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা এবং বিশ্বের বহুল প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে একটি (ভাষাভাষীর সংখ্যানুসারে এর অবস্থান চতুর্থ[২] থেকে সপ্তমের[৩] মধ্যে)। বাংলা ভাষাটি বাংলাদেশের প্রধান ভাষা এবং ভারতে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কথিত ভাষা । অসমীয়া ভাষা এবং বাংলা ভাষাটি কাছাকাছি মনে করা হয়।



ইতিহাস

খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের শেষ প্রান্তে এসে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকে যে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলোর উদ্ভব ঘটে, তাদের মধ্যে বাংলা একটি [৬]। কোন কোন ভাষাবিদ তারও অনেক আগে, ৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, বাংলার জন্ম হয় বলে মত পোষণ করেন। [৭] তবে এ ভাষাটি তখন পর্যন্ত কোন সুস্থির রূপ ধারণ করেনি; সে সময় এর বিভিন্ন লিখিত ও ঔপভাষিক রূপ পাশাপাশি বিদ্যমান ছিল। যেমন, ধারণা করা হয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর দিকে মাগধি অপভ্রংশ থেকে মাগধি অবহট্‌ঠের উদ্ভব ঘটে। এই অবহট্‌ঠ ও বাংলা কিছু সময় ধরে সহাবস্থান করছিল। [৮]
বাংলা ভাষার ইতিহাসকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয়
  1. প্রাচীন বাংলা (৯০০/১০০০ খ্রিস্টাব্দ – ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ) — লিখিত নিদর্শনের মধ্যে আছে চর্যাপদ, ভক্তিমূলক গান; আমি, তুমি, ইত্যাদি সর্বনামের আবির্ভাব; ক্রিয়াবিভক্তি -ইলা, -ইবা, ইত্যাদি। ওড়িয়াঅসমীয়া এই পর্বে বাংলা থেকে আলাদা হয়ে যায়।
  2. মধ্য বাংলা (১৪০০–১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) — এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ লিখিত নিদর্শন চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন; শব্দের শেষে “অ” ধ্বনির বিলোপ; যৌগিক ক্রিয়ার প্রচলন; ফার্সি প্রভাব। কোন কোন ভাষাবিদ এই যুগকে আদি ও অন্ত্য এই দুই ভাগে ভাগ করেন।
  3. আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে) — ক্রিয়া ও সর্বনামের সংক্ষেপন (যেমন তাহারতার; করিয়াছিলকরেছিল)।
বাংলা ভাষা ঐতিহাসিকভাবে পালির সাথে বেশি সম্পর্কিত হলেও মধ্য বাংলায় (চৈতন্য যুগে) ও বাংলা সাহিত্যের আধুনিক রনেসঁসের সময় বাংলার ওপর সংস্কৃত ভাষার প্রভাব বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ও মারাঠির শব্দভাণ্ডারে প্রচুর সংস্কৃত শব্দ রয়েছে; অন্যদিকে হিন্দি ও অন্যান্য ভাষাগুলো আরবি ও ফার্সি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

১৮শ শতকের পূর্বে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পর্তুগিজ মিশনারি পাদ্রি ম্যানুয়েল দ্য আসুম্পসাও Vocabolario em idioma Bengalla, e Portuguez dividido em duas partes নামে বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান ও ব্যাকরণ রচনা করেন; ১৭৩৪ থেকে ১৭৪২ সাল পর্যন্ত ভাওয়ালে কর্মরত অবস্থায় তিনি এটি লিখেছিলেন।  ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড নামের এক ইংরেজ প্রাচ্যবিদ বাংলার একটি আধুনিক ব্যাকরণ লেখেন, (A Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮)) যেটি ছাপাখানার হরফ (type) ব্যবহার করে প্রকাশিত সর্বপ্রথম বাংলা গ্রন্থ।  বাঙালিদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন প্রথম ব্যাকরণ রচয়িতা; তাঁর গ্রন্থের নাম "Grammar of the Bengali Language" (১৮৩২)।. এ সময়ে ক্রমশ সাধুভাষা থেকে সহজতর চলিতভাষার প্রচলন বাড়তে থাকে।[১০]
১৯৫১–৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে (এখনকার বাংলাদেশে) সংঘটিত "ভাষা আন্দোলনের" ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা।  পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র উর্দু ভাষাকেই সাংবিধানিক ভাবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।


ভৌগোলিক বিস্তার

বাংলা দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বভাগের বঙ্গ বা বাংলা নামের অঞ্চলের লোকদের মাতৃভাষা। এ অঞ্চলটি বর্তমানে ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সমন্বয়ে গঠিত। বাংলাদেশের প্রায় ৯৮% মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। [এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও পাশ্চাত্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাভাষী বাস করেন।

সরকারি মর্যাদা

বাংলা দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এছাড়াও ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম।[৪] ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা হল বাংলা[১৩] এবং আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকার তিন জেলা কাছাড়, করিমগঞ্জহাইলাকান্দিতে স্বীকৃত সরকারি ভাষা হল বাংলা।[১৪] এছাড়াও বাংলা ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম প্রধান স্বীকৃত ভাষা।[১৫][১৬] সম্প্রতি বাংলা ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

                                                  " উইকিপিডিয়া থেকে "