ছবির হাটের গেইট দিয়ে সোহরাওয়ারদিতে ঢুকল রাশেদ। চমৎকার এ প্রকৃতি দর্শন করা যাক। আকাশে বিরাট এক থালার মতো চাঁদ- চারিদিকে বইয়ে দিচ্ছে তার ঝকমকে আলোর বন্যা। দূর থেকে মৃদু গাড়ির আওয়াজ, মানুষের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। পাখির কিচিরমিচির নেই-সব বোধহয় সন্ধ্যা নামায় নীড়ে ফিরে গেছে। তবে বেড়েছে সন্ধ্যা রাতের অন্য পাখির আনাগোনা। একটু বা দিকের এককোণ থেকে ভেসে এল মেয়েলি কণ্ঠের চাপাহাসি। চাঁদের আলো কিংবা রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো ঐ কোণগুলি যেন আরও জমাট আধার করে দিয়েছে। আবছা আলোয় একটা সাদা শার্ট পড়া লোকের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে। তার সাদা ভৌতিক হাতের ছায়া উঠছে-নামছে, নড়ছে। খুব ব্যস্ত কোন গুপ্তরহস্য উন্মোচনের আনন্দ নিতে। নিষিদ্ধ আনন্দ... হাহ !! সব মোহ-ক্ষণিকের মোহ... এই মোহ,আনন্দের স্বাদ পায়নি রাশেদ জীবনে। কিন্তু কি দরকার? সবচেয়ে বড় যে মোহ-জীবনের মোহ, তাইতো শেষ হয়ে গেছে ওর।
আজ রাশেদের জন্মদিন। আজ দিনটা রাশেদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আজ রাশেদের মৃত্যুদিনও বটে। আজ
রাতই ওর জীবনের শেষ রাত। আত্মহত্যা করবে ও। পৃথিবীর অনেক বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির
জন্ম আর মৃত্যুদিন একই। আজকের দিনটা মৃত্যুদিন হিসেবে বেছে নেয়ার কারণ-দিনটা
রাশেদের খুব পছন্দ। না, অনেক মানুষ তাকে উইশ করে, গিফট দেয়, ওর জন্য বিশেষ কিছু করার চেষ্টা করে
তাও না। কারণটা হল, ওর নিজের বলতে, নিজের পরিচয় বলতে এই একটা দিনই ওর কাছে আছে।
বাইশ বছর আগের কথা। ভাদ্র মাসের প্রচণ্ড গরমে একটা মোটা
কাপড় পেঁচানো বাচ্চাকে দেখা গেল এক মাদ্রাসার সামনে। হয়তো কাপরের পুটুলির ভেতর যে
একটা বাচ্চা থাকতে পারে তা কেউ বুঝতেও পারতোনা। মোটা কাপড়ের ভেতর গরমে অতিস্ট হয়েই
বাচ্চাটা হয়তো চিৎকার করে নিজের অস্তিত্ব জাহির করেছিল। মাদ্রাসার ইমাম এগিয়ে
এলেন। বাচ্চাটার গায়ে রক্তের ছোপ তখনো লেগে আছে। কয়েক ঘণ্টা আগেই জন্ম হয়েছে। অনেক
খোঁজ করেও যখন বাচ্চার পরিচয় পাওয়া গেলনা তখন বাচ্চাটার জায়গা হল এতিমখানায়।
এতিমখানাতেই বাচ্চাটা বড় হতে থাকলো, পড়াশুনা চলতে থাকল। দিনে সীমিত খাবার আর রাতে ঠাণ্ডা, ভেজা মেঝেতে ঘুম- ছেলেটার স্বাস্থ্যও খারাপ হতে থাকল দিনে দিনে। ইমাম
সাহেব ভালো চোখে দেখতেন ওকে। পড়াশুনায় ভালো বলে তার জানাশোনা এক স্কুলে বিশেষভাবে
ওকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। একসময় রাশেদ এসএসসি পাস করল। এক সরকারি কলেজে ভর্তিও
হয়েছিল কিন্তু পড়াশুনাটা আর হলনা। ইমাম সাহেব মারা গেলেন। নিজের খরচ চালাতে
ছোটখাটো কাজ করে আর পড়াশুনা হলনা। বছর দুয়েক পর যাত্রাবাড়ীতে ছোট্ট একটা ফোনের
দোকান দিলো ও। দিনে কাজ, রাতে মেসে এসে ঘুমানো, কখনো একাকি নির্ঘুম রাত পার করা এই হয়ে গেল জীবন।
ভাবতে উদ্যানের লেকের কাছে এসে পড়ল ও। একটা কংক্রিটের বেঞ্চে বসলো। আশেপাশে কত মানুষ, কত প্রাণচাঞ্চল্য। পাশের বেঞ্চে হাত ধরাধরি করে বসে আছে একজোড়া ছেলেমেয়ে। ভালবাসার আবেশে আছে ওরা কিন্তু কণ্ঠে অনিশ্চয়তার ছাপ।
-জাকির, আমাদের বিয়েটা কবে হবে? বাবা মাকে আর কতদিন আটকে রাখতে পারব? আগামীকালও এক পাত্রপক্ষ আসবে শুনলাম। এমনি আর কতদিন বিয়ে করবনা জিদ দেখিয়ে ওদের না করব?
-এইতো আর কিছুদিন জান। নতুন চাকরি। আর কিছুদিন পেলেই সবদিক গুছিয়ে আনতে পারবো। তারপরই তোমার বাসায় প্রস্তাব...
রাশেদ হাসল। আর কিছুদিন পর সব গুছিয়ে তারপর ছেলেটা মেয়েটার বাসায় প্রস্তাব দিবে! অথচ, স্বর্ণাকে পেলেই ওর অগোছালো জীবনটা এমনি এমনি গুছিয়ে যেত। হাহ...স্বর্ণা...
স্বর্ণা প্রায়ই ওর দোকানে আসতো ফোন করতে। কখনো কলেজ থেকে ফেরার সময় আবার কখনো বিকেলে হঠাৎ করেই। ফরসা, গোলগাল মুখ, খাড়া নাক। চুল কিভাবে বাধত কে জানে কিন্তু সবসময়ই চুলের একটা গোছা বাকা হয়ে কপালে পড়ে থাকতো। দেখতে ভালো লাগত। মেয়েটাকেই রাশেদের ভালো লাগত। ধীরেধীরে ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছিল ওদের মাঝে। রাশেদ স্বর্ণাকে ওর জীবনের সব কথা বলেছিল। ফোন না করলেও মাঝেমাঝে দোকানে এমনি আসতো স্বর্ণা। ওর সাথে কথা বলতো। রাশেদের জীবন আনন্দে কাটছিল। সারাদিন একটা অনিশ্চিত অপেক্ষা ওর আসার, আর আসলে সারাদিনের অপেক্ষার ক্লান্তি জয়।
একদিন স্বর্ণাকে কলেজ থেকে ফেরার সময় ও নিয়ে এল এই সোহরাওয়ারদিতে। নতুন একটা লাল শার্ট পড়েছে। রাশেদ ওকে মনের কথাটা বলে ফেলল। স্বর্ণা চুপ, গম্ভীর।
স্বর্ণা, কিছু বল।
এটা সম্ভব না। আপনি অসম্ভব একটা কথা বলেছেন।
কেন? আমিতো ভাবতাম তুমিও আমাকে পছন্দ করো। তুমি যে প্রায়ই দোকানে কথা বলতে আসতে আমার সাথে আমিতো ভেবেছিলাম তুমিও আমার মত...
আপনি ভাবলেন কিভাবে!! আমি আপনার দোকানে কিছুদিন গেলাম আর আপনি ভেবে নিলেন যে লোকটার জন্ম পরিচয় নাই, জন্মের ঠিক নাই তাকে আমি ভালবাসি !!! এটা ভাবার সাহস কিভাবে হল আপনার !!
রাশেদের চারপাশ দুলতে লাগলো। অবাক ব্যাপার! ও কেন আগে কথাগুলি ভাবেনাই! ছোটবেলা থেকে কয়জনের কাছ থেকে মানুষের মতো আচরণ পেয়েছে? জন্ম নিয়ে সন্দেহ, পরিচয়হীনভাবে এ পৃথিবীতে এসে যে অন্যায় ও করেছে তাতে স্বাভাবিক জীবনের আশা কি ও করতে পারে?
স্বর্ণা উঠে চলে গেল। রাশেদ বসেই রইল। ওর আর কখনো স্বর্ণার সাথে দেখা হয়নি।
২।
শিখা অনির্বাণের পাশে দেয়ালের উপর বসে আছে রাশেদ। প্রায় রাত সাড়ে দশটা বাজে। নিচে দেখা যাচ্ছে আরেক দুনিয়া। অনেক লোক, যুবক বসে গাঁজা টানছে, কেউকেউ আরও কিসব মাদক। নেশার ঘোরে ওরা হয়তো অন্য এক জগতে প্রবেশ করছে যেখানে বাস্তব পৃথিবীর কোনও ঝুটঝামেলা নাই। শুধু ঘোরলাগা কিছু মুহূর্ত জীবন পার করে দেয়া।
রাশেদ নেমে আসে। এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
পার্কের রমনার মুখোমুখি মেইন গেটটার পাশে বকুলতলার নিচে একটা পরিবার অস্থায়ী আশ্রয় নিয়েছে। তিনজনের পরিবার। মাঝবয়সি এক পঙ্গু লোক, তার স্ত্রী আর ২-৩ বছরের একটা বাচ্চা। পরিবারটির পেশা হয়তো ভিক্ষাবৃত্তি আর রাতের অস্থায়ী আবাস এখানে। গায়ের উপর কাপড় মুড়ি দিয়ে ঘুম দিলেই তো রাত পার। রাশেদ একটু দূরে সাইডওয়াকে বসে তাদের দেখছে। রান্নার আয়োজন চলছে-মেইনরোডের সাইডওয়াক থেকে ৫-৬টা ইট খুলে এনেছে বউটা। কিছু ডালপাতা আগেই যোগাড় করেছে। রাশেদের বারবার চোখ যাচ্ছে বাচ্চাটার দিকে। অনেক আনন্দে আছে বাচ্চাটা- বাবার কোলে হুটোপুটি খাচ্ছে, আধোআধো কথা বলছে...। আহা! ও যদি নিজেও এভাবে বাবা-মার বুকে এভাবে হুটোপুটি খেতে পারত !!
‘সালমা… ও সালমা। কই গেলি বাচ্চা ফালাইয়া- … ওই সালমা…’
লোকটার চিৎকার শুনে বাস্তবে ফিরে এল রাশেদ। আবার তাকাল ওর দিকে। লোকটা বউকে ডেকেই যাচ্ছে। বাচ্চা কাঁদছে।
‘ও ভাই… ও…’। রাশেদ আবার তাকাল। লোকটা তার দিকে চেয়ে ডাকছে তাকে। রাশেদ উঠলো।
জী বলেন…
ভাই, আপনেরে তো আগে এইখানে দেহিনাই। আপনি ক্যাডা? এইখানে রাইতের বেলা যত ব্যাটা আহে গাঞ্জা খাইতে, নিশা করতে হেগো সবতেরে আমি মুখ চিনি। আপনেরে তো আগে দেহিনাই।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আমি এখানে নেশা করতে আসিনি। অন্য দরকারে এসেছি।
কিসের দরকার?
আমি এখানে মরতে এসেছি। মৃত্যুর আগে শেষবারের মত প্রকৃতি, জীবন দেখতে এসেছি এখানে।
মরতে আইছেন !
কি কন?? কিল্লিগ্যা (কীজন্য)? হইছেডা কি?
শুনে আপনি কি করবেন? অবশ্য আপনাকে বললেও ক্ষতি নাই। কারো না কারো গল্পটা তো জানা দরকার- আমিও তাতে মন হাল্কা করে মরতে পারবো। ছেলের সাথে আপনার আদর মাখা সম্পর্ক দেখে খুব ভাল লেগেছে। আবার খারাপও লেগেছে। নিজের জন্য। আমার বাবা নেই। আসলে বাবা মা কেউ নেই- আমি জানিইনা আমার বাবা মা কে। জন্ম সম্পর্কে একটা জিনিসই শুধু আমি
জানি। যে আজ আমার জন্মদিন…
লোকটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল রাশেদের দিকে। ‘ভাই আপনি বসেন। আপনার গল্পটা পুরাটা শুনিনাই। থাক, আপনেরে একটা গল্প শুনাই। আমার গল্প…’
রাশেদ বসলো। লোকটা পা ছেঁচড়ে নিজেকে টেনে আনল ওর মুখোমুখি। বাচ্চাটার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
‘ভাই, আমার নাম নুরু। এর আগেও কিছু নাই, পরেও কিছু নাই। সবাই ন্যুরা ডাকে। নামটা কে দিসে তাও কইতে পারতাম না। একদম ছোট্টকাল থেইকা আমি এই রাস্তায়। রাস্তার আগে কোথাও ছিলাম কিনা তাও জানিনা। কারণটা আপনের মতনই। কখনও জানিনাই আমার বাপ মা ক্যাডা। কতবেলা না খাইয়া থাকছি হিসাব নাই। কত্ত কাম করছি প্যাডের (পেটের) দায়ে। মিন্তির কাম করসি, রিকসা ঠেলসি, কাগজ টোকাইসি, খিদার চোটে হোটেল থেইকা খাওন চুরি করতে গিয়া মাইরও খাইসি। কেউ মায়া দেখায়নাই। মায়া দেখাইব ক্যাডা? আমার লগে রাস্তায় যেসব পোলাপান ছিল তারাও আমারে জাউরা জাউরা কইয়া গাইল(গালি) দিত…’
নুরু থামল। স্মৃতিচারন করতে গিয়ে চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। রাশেদ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
‘একটু বড় হইতে রাস্তায় ফেরি করা শুরু করলাম। বাসে বাসে এইডা ওইডা বিক্রি করতাম। একবার এক বাস থেইকা পত্রিকা বেইচা নামার সময় পা পিছলাইয়া পইড়া গেলাম। হাহ- পা দুইডাও গেল। কন ভাই, জীবন থেইকা কি পাইলাম? তাও ভাই আমি হাল ছাড়িনাই। এক জন্ম পরিচয় না থাকায় এই জীবনে কেউ মায়া করেনাই, কেউ বোঝেনাই যে আমি মায়ার কত কাঙ্গাল। তখনি ভাবসি যে আমি যে কষ্ট পাইসি তা আমার সন্তানরে কখনও পাইতে দিমুনা। ওরে মায়ায় মায়ায় ভরায় রাখুম। আর কেউ আমারে মায়া করেনাই- আমার বউ পোলাপান থেইকা সেই মায়া আমি নিমু…’
কোলের বাচ্চাটা নড়ে উঠলো। উষ্ণতা পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। নুরু তাকে বুকে জড়িয়ে বলল-
‘ভাই, আমগো যেই জিনিসটা দরকার তা হইল মায়া। একবার কারো মায়া পান- দেখবেন জীবনডা কত সুখের। কষ্ট সক্কলের আছে। এক্কেবারে বড়লোক থেইকা গরিব পর্যন্ত সবার। আমি সারাদিন ভিক্ষা করি, পাও নাই, কোনও থাকার জায়গা নাই- কিচ্ছু নাই। কিন্তুক, যখন এই পোলাডা, বউডা মায়া করে, লগে ঘুমায়, আমি অগো মুখের দিকে চাইয়া থাকি। কত্ত সুখ লাগে। ভাই, মরন কোনও কিছুর সমাধান না। নিজের সবকিছু দিয়া সুখ বানাইয়া নেয়া, খুইজা নেয়াতেই সমাধান’।
নুরু রাশেদের পিঠে হাত রাখল। রাশেদ ডুকরে কেঁদে উঠে। নুরু চিৎকার করে উঠে। ‘সালমা, ওই সালমা… খিচুড়ি বহা। আজ না ভাইএর জন্মদিন … ওই, কি কই শুনস???’
রাশেদ ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝাপসা চাঁদটা আজ যেন অনেক বড়। ওর সারা শরীর চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। রাতের অন্ধকার, গাছের ছায়া কিছুই সে আলো আটকাতে পারছেনা।
রাশেদ পাশে তাকাল। সালমা খিচুড়ি বসিয়েছে। ঘ্রাণ ছড়িয়েছে সবদিকে। খাবারের ঘ্রাণ, জীবন উপাদানের ঘ্রাণ, জীবনের ঘ্রাণ। নুরুর দিকে তাকাল। নুরুর চোখে অকৃত্রিম মায়া। হয়তো আরও কেউ আরও বেশি মায়া নিয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্য জীবনে।
আশা।বেঁচেথাকারআশা।জন্মদিনেরাশেদেরসবচেয়েবড়উপহার।
"সংগ্রহৃত"