আপনি কি বাংলাদেশের শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগ
করতে চান? বন্ধু বান্ধব এবং অফিস কলিগদের কাছে শুনেছেন, শেয়ার ব্যবসায়
শুধু লাভ আর লাভ, রাতারাতি কোটিপতি। আর দশটা ব্যবসার মতো এটাও একটা ব্যবসা,
যাতে ঝুঁকি আছে। বর্তমানের বিনিয়োগকারীরা যে ভাবে বিনিয়োগ করে থাকে তাকে
ট্রেডিং না বলে গ্যাম্বলিং বলাই ভাল। কিন্তু আসলেই কি শেয়ার
ব্যবসায় গ্যম্বলিং? না শেয়ার ব্যবসায় গ্যাম্বলিং না বরং ইনভেষ্টমেন্ট, একটি
বিজনেস। একজন সফল বিজনেসম্যান হতে হলে অবশ্যই আগে ব্যবসাটা সর্ম্পকে জানতে
হবে। এটার পুরা আইডিয়া নিতে হবে। নিজের ব্যবসাটাকে প্রফিটেবল বানাতে চাইলে
এবং লসের হাত থেকে বাচতে চাইলে অবশ্যই খুটিনাটি সব কিছু জানতে হবে।
তবে হতাশ হবার কিছু নেই। শেয়ার ব্যবসায় বুঝে শুনে টাকা খাটালে আসলেই যথেষ্ট
পরিমান লাভ আছে। শেয়ার বাজারে পুঁজি বিনিয়োগ করে বিশাল লাভবান হবার কোন
সুনির্দিষ্ট বা শর্টকাট পথ নেই। তবে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চললে
নিঃসন্দেহে আপনি লাভবান হতে পারবেন।
শেয়ার বাজার এ বিনিয়োগের আগে বিবেচ্য বিষয়।
১.
বাবসায়িক শিক্ষঃ যখনি আপনি একজন শেয়ার ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে দেখার জন্য
প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনি আপনাকে শেয়ার ব্যবসায় বা শেয়ার বাজার সর্ম্পকে
এডুকেটেড হতে হবে। নিজেকে যুদ্ধক্ষেত্রে টিকার জন্য নলেজ এর অস্ত্রে
সু-সজ্জিত হতে হবে। জানতে হবে এটির আদ্যোপান্ত, মার্কেট এর সকল ফ্যাক্টর
এবং নিজেকে আপটুডেট রাখতে হবে সবসময়- বিশেষ করে দেশের ইকোনোমিক এবং পলিটিকাল বিষয়। প্রথমেই
মনে রাখবেন, শেয়ার ব্যবসা কোন জুয়া খেলা নয়। এখানে ব্যবসার কিছু
সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। রয়েছে কিছু সুনির্দিষ্ট গানিতিক হিসাব। আপনি যদি
কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডের হন তবে এই গুলি বুঝতে আপনার খুবই সুবিধা হবে। আর
আপনি কমার্সের স্টুডেন্ট না হলেও খুব একটা সমস্যা নেই। বাজারে এখন শেয়ার
বাজার এর উপর অনেক বই পত্র পাওয়া যায়। এগুলি পড়ুন, বোঝার চেষ্টা করুণ।
শেয়ার বাজার এর উপর ইন্টারনেটেও অনেক লেখা পাওয়া যায়, প্রতিনিয়ত পড়ুন এবং
বুঝুন।
২.
প্রতিদিন কিছু পড়াসুনা করুন এবং মার্কেট এর সাথে তা মিলিইয়ে দেখুন,
মার্কেট মুভমেন্ট গুলো বোঝার চেষ্টা করুন। কিছুদিন পড়াশুনার পর যদি দেখেন
বুঝতে সমস্যা হচ্ছে তবে সিকিউরিটি এক্সচেন্জ কমিশন এবং ঢাকা স্টক এক্সচেন্জ
এর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। এই গুলির খরচ অনেক কম।
নিঃসন্দেহে উপকার পাবেন। তাছাড়া অনেক এক্সপার্ট আছেন বাংলাদেশে, তাদের
সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। তবে অনেক ফি দিয়ে কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির প্রয়োজন
নেই।
৩. এবার ভাল
একটি স্ট্রাটেজি তৈরি করে সেটাকে ধরে নিজে নিজে সাইলেন্ট ট্রেড করুন। তার
মানে আজকে একটা শেয়ার আপনার স্ট্রাটেজি অনুযায়ী কি হওয়া উচিৎ তা চিন্তা
করুন এবং তার ফলাফল পরিমাপ করুন। তেমনি স্ট্রাটেজি টেষ্ট এর সময়ই আপনাকে
ট্রেড ম্যানেজমেন্ট শিখতে হবে। রিস্ক – রিওয়ার্ড জানতে হবে। কখনো লসে চলে
গেলে কি করবেন সেসব বুঝতে হবে। টেকনিক্যাল আর ফান্ডামেন্টাল এনালাইসিস করে
ট্রেড নিতে হবে। অনেক সময় আপনার স্ট্রাটেজিতে ট্রেড নেবার সময় আসলেও
মার্কেট এনালাইসিস করে দেখতে পাবেন আপনার স্ট্রাটেজিতে এখন ট্রেড নেয়াটা
রিস্কি হয়ে যাচ্ছে। তখন ট্রেড থেকে বিরত থাকতে হবে। অথবা ট্রেড দিয়ে ফেললেও
সেটাকে ম্যানেজিং করতে হবে। একটা গুরুত্ত পূর্ণ বিষয় হল অন্য কাউকে দেখে
শেয়ার কেনাবেচা করবেন না। প্রত্যেকের পোর্টফোলিও ভিন্ন হয়। কোন একজন যে
কারণে শেয়ার কিনছেন বা বিক্রি করছেন তা হয়তো আপনার কারণের সাথে মিলবে না।
৪.
বাজারের কোন গুজবে কান দিবেন না। শেয়ার বাজার যখন ভাল থাকে তখন প্রচুর
গুজব শুনা যায়। আমার পরামর্শ হলো গুজবে কাননা দিয়ে খুবই ছোট আকারে শুরু
করুন। আস্তে আস্তে প্রফিট করুন। খুব কম প্রফিট টার্গেট হলে রিস্কটাও খুব কম
হয়। ওমুক কোম্পানী ১:৩ রাইট শেয়ার দিবে, তমুক কোম্পানী ৩০০% বোনাস দিবে,
আর এক কোম্পানী ৬০০% ক্যাশ দিবে এ জাতীয় গুজবে কান দিবেন না।
৫. অনেকেই
আছেন যারা বিও একাউন্ট কোন মার্চেন্ট ব্যাংক এ খুলে সামান্য কিছু টাকা
ইনভেস্ট করে ২ গুন লন নিয়ে ট্রেড শুরু করেন। নতুন ব্যবসায় নামার অন্তত এক
বছর ঋণ কোডে শেয়ার কিনবেন না। আগে ব্যবসাটা ভাল করে বুঝে শুনে তারপর ইচ্ছা
হলে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনার নিজের টাকায় লস হলে আপনার কিছু
ক্ষতি হবে। কিন্তু ব্যাংক কখনোই লস নেয়না। বাংকের টাকায় শেয়ার কিনে লস হলে
ব্যাংক আপনার মূল টাকা থেকেই লস সমন্বয় করবে। তখন একটা শেয়ার এর দাম কমে
গেলে ব্যাংক আপনার শেয়ার ফরসড সেল করে দিয়ে তার টাকা নিয়ে নিবে আর আপনার
একাউন্ট শুন্য হয়ে যাবে। হায় হায় করা ছাড়া আপনার আর কোন গতি থাকবে না। ধরা
যাক, আপনি ‘কখগ’ কোম্পানীর শেয়ার ৫০ টাকায় ১ টি শেয়ার কিনলেন। পরবর্তীতে
মূল্য কমে যাওয়ায় আপনি সেই শেয়ার ৩০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। আপনার
ক্ষতি হলো, ( ৫০-৩০ )=২০ টাকা। কিন্তু আপনি যদি ঋণ কোডে ব্যবসা করতেন,
তাহলে হয়তো ৫০ টাকায় আরও ৫০ টাকা, মোট ১০০ টাকার শেয়ার কিনতে পারতেন। তখন
আপনার ক্ষতি হতো ( ৫০ – ৩০ ) * ২ = ৪০ টাকা। এরপরও আছে শেয়ার কেনাবেচার
কমিশন এবং ঋণের সুদ। যা আপনার ক্ষতির পরিমান আরও বারিয়ে দিবে। সুতরাং যত
আকর্ষণীই মনে হোক না কেন নতুন বিনিয়োগকারীদের মার্চেন্ট ব্যাংকের ফাঁদে পা
না দিয়ে লন করে শেয়ার বাবসা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মানি ম্যানেজমেন্ট সম্পরকে জানুন।
৬. ভাল
মৌল ভিত্তি সম্পন্ন শেয়ার ক্রয় করুণ। যদিও এটা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে।
কারণ বিগত ৫/৭ বছরে দেখা গেছে ভাল মৌল ভিত্তি সম্পন্ন শেয়ারের চাইতে আজে
বাজে শেয়ার, এমনকি কোম্পানীর অস্তিত্ব নেই, কোন লভ্যাংশ দেয়না, এমন সব
শেয়ারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এ বিসয়ে একটা গল্প বলি, ঠিক গল্প নয়
সত্যি ঘটনা,শেয়ার মার্কেট এ ট্রেডিং শেখায় এমন বহু প্রতিষ্ঠান আগে
বাংলাদেশে ছিল, অবশ্য এখন তারা হারিয়ে গেছে, তো একবার এমন এক নাম করা
ট্রেনিং সেন্টার এর আমন্ত্রনে সেখানে গেস্ট লেকচারার হিসাবে গল্প করতে
গিয়েছিলাম। আমি যখন ক্লাসে প্রবেশ করলাম তখন ঠিক পেছনের সিট থেকে এক মাঝ
বয়সি লোক দাড়িয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন, ভাই! ফান্ডামেন্টাল শেয়ার কি? আমি
ক্লসে ঢুকেই এই জাতীয় প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হলাম। পরে বুঝতে পারলাম
সারাদিন রেডিও, টেলিভিশনে ফান্ডামেন্টাল শেয়ার এর নাম শুনতে শুনতে হয়তো তার
এই আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং শুধুমাত্র এটা শেখার জন্যই আজকে এসেছেন। প্রশ্নের
উত্তরে আমি উনাকে বললাম আপনার প্রশ্নের মধ্যই আপনার উত্তর লুকিয়ে আছে। উনি
বুজতে পারলেন না। আমি বললাম, ফান্ডামেন্টাল শব্দটা আস্তে আস্তে ভেঙ্গে
ভেঙ্গে বলেন উত্তর পেয়ে জাবেন।
উনি বললেন ফান্ডা-মেন্টাল, আমি বললাম আরও আস্তে বলেন, তারপর বললেন ফান-ডা- মেন্টাল।
হা! এটাই সঠিক উত্তর! তার মানে হল যে শেয়ারে ফান্ড দিয়ে বা ফান্ড ইনভেস্ট করে আপনি মেন্টাল হয়ে জাবেন তাকেই ফান্ডামেন্টাল শেয়ার বলে।
প্রসংঙ্গেও বলা যায়, এগুলি বাড়ার পেছনে
বিনিয়োগকারীদের অজ্ঞতাই দায়ী। তাই আজেবাজে শেয়ার না কিনে ভাল মৌল ভিত্তি
সম্পন্ন শেয়ার কিনুন। তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পথে বসবেন না বরং খুব ভাল
লাভই পাবেন। ভাগ্যের উপর নির্ভর করা থেকে শেয়ার বাবসার এর ভিবিন্ন দিক
নিয়ে শিক্ষা গ্রহন ও এনালাইসিস আপনাকে আরও ভালো এবং consistant প্রফিট পেতে
সহায়তা করবে। ইমশন কন্ট্রোল করতে শিখুন । নিজেকে কখনই ইমশন দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত হতে দিবেন না। ইমশন কে নিয়ন্তন যারা করতে পারবে না তারা প্রফিট
কে দেখবে হুর হুর করে নিচে নামতে এবং লস কে দেখবে হুর হুর করে উপরে
উঠতে। যেকোনো স্ট্রেটাজির ক্ষেত্রেই একসাথে একসাথে অনেক প্রফিট করতে যাবেন
না। মানি মেনেজ মেন্ট এর সাহায্য নিয়ে ধিরে ধিরে আগান। তাহলে শেয়ার বাবসায়
এর যেকোনো ঝড় মুকাবেলা করতে আপনি সক্ষম হবেন। এই সম্পর্কিত একটা বিস্তারিত আর্টিকেল পড়ুন এখানে।
৭.
শেয়ার বাবসার খুঁটিনাটি সকল বিসয়ই বোঝার চেষ্টা করুণ। নগদ টাকা দিয়ে
ব্যবসা করবেন আর কিছু বুঝতে চাইবেন না, এর চাইতে আহম্মকি আর কি হতে পারে?
বোঝার সবচেয়ে সহজ পথ হলো প্রতিনিয়ত আপডেট থাকা। চোখ কান খলা রাখা। শেয়ার
বাজারে বিনিয়োগের প্রথম দিকে এই সম্পর্কিত লেখা লেখিতে, পত্র পত্রিকাতে
প্রচুর সময় দিন। সব সময় ডিএসই এর এবং ট্রেডিং সম্পর্কিত আরও অনেক ওয়েবসাইটে
নজর রাখুন এবং সমস্ত ইনফরমেশন এ চোখ বুলান। প্রথম দিকে এটা খুব কঠিন মনে
হতে পারে, অনেক যামেলার মনে হতে পারে। কিন্তু বছরখানেক গেলেই দেখবেন আর অত
সময় দিতে হবে না, অল্পতেই বুঝতে পারবেন।
৮. অন্নের
কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে কখনোই শেয়ার ব্যবসায় নামবেন না। মনে রাখবেন এই
ব্যবসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত। আমি মনে করি, যে টাকা হারিয়ে
গেলে, চলে গেলে বা নষ্ট হলে আপনার কস্ট লাগবে না সেই টাকাই শেয়ার ব্যবসায় এ
ইনভেস্ট করা উচিৎ। বাপের জনি বেছে, মায়ের গহনা বেচে, কস্টের জমানো টাকা
শেয়ার ব্যবসায় বা শেয়ার বাজার এ ইনভেস্ট করা কখন ই উচিৎ নয়। এখানে যেমন
প্রতি তিন দিনে লাভের সম্ভাবনা আছে, তেমনই প্রচুর ঝুঁকিও রয়েছে। তাই ব্যাংক
লোন নিয়ে, জমি বিক্রি করে, অন্যের থেকে টাকা ধার করে, অলংকার বা ফ্ল্যাট
বন্ধক রেখে কখনোই শেয়ার ব্যবসায় নামবেন না।
৯. প্রতিদিন
লাভ হোক বা লস সবসময় সেটায় ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখুন। কেন প্রফিট হলো
কেন লস হলো সব লিখে রাখুন, তাহলে আপনার লস বা প্রফিটের কারণগুলার রেকর্ড
থাকবে। আর সব সময় সব জান্তা লোকজন থেকে দূরে থাকুন। শেয়ার মার্কেটে এমন
অনেক লোক দেখা যায়, যারা প্রচুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলে। প্রকৃত অর্থে
তারা ৩/৪ বছর ব্যবসা করেও তেমন কিছু লাভ করতে পারে না। যারা গেম্বলার তাদের
জন্য উপযুক্ত স্থান হল CASINO. আর শেয়ার ব্যবসায় হল তাদের জন্য যারা
ইনভেস্টমেন্ট এ আগ্রহি এবং তা থেকে ছোট পরিমাণ প্রফিট পেয়েই খুশি হবে।
সুতরাং এই ধরণের লোকজন থেকে কম করে হলেও ১০০ হাত দূরে থাকুন।
১০.
একটা ভালো ব্রোকার এ ট্রেড করুন। নিজের স্ত্রেটেজির জন্য উপযুক্ত একটি
ব্রোকার নির্বাচন করুন। বিশ্বস্ত এবং বড় সিকিউরিটি হাউজ বা বড় বিশ্বস্ত
ব্যাংকে বেনিফিশিয়ারি অ্যাকাউন্ট বা বিও খুলতে পারেন। এখানে ভাল
সুযোগ-সুবিধা আশা করা যায়, এবং ব্যবহারও নিঃসন্দেহে ভাল পাবেন। ফোনে ট্রেড
করা, অনলাইন ট্রেডিং করা সহ আপনার জমা ও উত্তলনের সময় ও অনেক গুরুত্তপুরন।
ভালো ব্রোকার এর আর একটা বড় সুবিধা হল কোন দূর্ঘটনা ঘটলে আশা করা যায় যে
তারা আপনার টাকা মেরে খাবে না। আর হ্যা, নমিনি করতে কখনোই ভুল করবেন না।
কারন মানুষের জীবন মৃত্যুর কথা কিছু বলা তো যায় না ! আর আপনার মোবাইল
নাম্বার এবং অ্যাড্রেস উপ টু ডেট রাখুন।
উপরের এই পরামর্শগুলি নতুন বিনিয়োগকারীরা
অবশ্যই মাথায় রাখবেন। আশাকরি শুভ ফলাফলই পাবেন। স্টক মার্কেটে আপনার যাত্রা
শুভ হোক, অনেক বেসি লাভবান হোক এই প্রত্যাশা রইল।