মনোবিদ অনুত্তমা মজুমদার বলছেন, “অনেক দিনের প্রেম, অনেক দিনের দাম্পত্য শরীরেও একটা একঘেয়েমি এনে দেয়। রোম্যান্স বা যৌন উত্তেজনা হারিয়ে যায়। ‘সেক্সটিং’ সেই বসন্তকে জ্বালিয়ে দেয়। আমার কাছে এমন অনেক ক্লায়েন্ট আসেন যারা বলেন, ও আমাকে আগের মতো আর ভালবাসে না। আসলে এটা ভালবাসার বিষয় নয়। কমিটেড রিলেশনে ভালবাসা বা কোনও সম্পর্কে উত্তেজনা ফিরিয়ে আনতে, অনেক দিনের চেনা সম্পর্কেও সেক্সটিং-এর প্রবণতা এখন বাড়ছে।”
সেক্স আর টেক্সট মেসেজকে একযোগে নিজের পছন্দসই শব্দে, ছবিতে ভরিয়ে ইনবক্স থেকে মেসেজবক্স সাজিয়ে তোলার নেশায় ভিজে যাচ্ছে বাঙালির চেতন-অবচেতন। কোথাও কিছুর যেন অপেক্ষা নেই, ফাঁক নেই। সেক্সটিং পুরিয়ে দিচ্ছে মন ছোঁওয়া শরীরী সাধ। লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ, প্রেমে ব্যথা পেয়ে সিঙ্গল থাকার ফূর্তি, প্রেম নয় অথচ প্রেম সম্পর্কে জেরবার এই প্রজন্ম বেঁচে আছে সেক্সটিং-এর খুঁটি ধরে। আপাত ‘ভালগার’ শুনে গা রি-রি করলেও, নিজের মতো ভাল থাকার এই জগতে ক্ষণিকের আনন্দযাপন থেকে বিরত থাকাই যে দায়!
তবে ‘সেক্সটিং’ কোনও নতুন শব্দ নয়। টেক্সট মেসেজের সঙ্গে রগরগে ভাষা এবং নিজের বা অন্যের ছবি পাঠানোই হল সেক্সটিং-এর মোদ্দা গপ্প। মূলত ২১ শতকের শব্দ সেক্সটিং। ২০১২ সালে মেরিয়ান ওয়েবস্টার ডিকশনারিতে এই শব্দ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সেক্সটিং এক্কেবারে নতুন শব্দ না হলেও যৌনতার ভাষা এখন বদলে গিয়েছে। তা এখন আর সুড়সুড়ির পর্যায়ে নেই। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের খোলা হাওয়ায় খুল্লামখুলা চুমু-র চমকের পর ‘সেক্সটিং’ শুনে মুখ লুকনোর দিন শেষ। ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে গেল বলে বাবা-মায়েরা যদি কাঁদতে বসেন তো সমূহ বিপদ! সম্পর্ক এখন আলগা চাওয়া-পাওয়ার। এই চাওয়া-পাওয়াগুলো সামনে যখন মেটে না তখন যদি তা ‘সেক্সটিং-এর মাধ্যমে জোটে তা হলে মন্দ কী? মনোবিদরা বলছেন, অস্থির জীবনে স্বস্তি আনতে সেক্সটিং-এর জুড়ি নেই, এতে মন ভাল থাকে।
সেক্সটিং কেমন করে চলে?
এই আলোচনা শুরু হয় অপর প্রান্তের মানুষটি কী পোশাক পরে আছে, তাই দিয়ে! তার পরবর্তী ধাপে দুই প্রান্তের নানা শারীরিক চাহিদা ফুটে ওঠে সেক্সটিং-এ। চালাচালি হতে পারে নিজেদের একাধিক নগ্ন শরীরের ছবি বা পর্ন ছবি। সেক্সটিং কি তা হলে এক ধরনের পারভার্সন? জোর আপত্তি তুলেছে এই প্রজন্ম।
“আমার অনেক সেক্সটিং পার্টনার আছে। সবাই ক্লাসমেট। এমনিতে মেসেজ হতে হতেই তো সেশন শুরু হয়। ভীষণ রিল্যাক্স লাগে আফটার সাচ সেশন। এর মধ্যে পারভার্সনের কী আছে? এটা জাস্ট একটা ভাললাগা। তা হলে তো পর্নোগ্রাফি দেখাও পারভার্সন। আর দু’জনের যেখানে সমর্থন রয়েছে সেখানে সেক্সটিং ইজ ভেরি হেলদি।” জোরের সঙ্গে বললেন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী অণ্বেষা।
এই প্রসঙ্গে অবশ্য সেক্সটিং নিয়ে আর একটা প্রশ্নও ওঠে! কারা এতে বেশি নিমগ্ন থাকে? মেয়েরা না ছেলেরা?
এখানে মেয়েরাই হাত তুলে নিজের অস্তিত্ব জানাচ্ছে। কাজের জন্য কথায় কথায় বিদেশে যাওয়া এই প্রজন্ম একে অপরকে কাছে পেতে, স্কাইপে, হোয়াটস অ্যাপে, নানা সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘সেক্সটিং’-এর মাধ্যমে নিজেদের চাহিদাকে উজাড় করে দিচ্ছেন। “আমার স্বামী থাকেন মিশিগানে। আমি কলকাতায় চাকরি করি। চাকরি ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা নিয়মিত স্কাইপে বা টেক্সট মেসেজে শরীর দেওয়া-নেওয়ার আনন্দটুকু মিটিয়ে নিই। আমি এতেই ভাল থাকি। আমার স্বামীর থেকে আমিই বেশি অপেক্ষা করে থাকি ভোরের জন্য, ওটাই আমাদের সময়। কখনও ও রাজি না থাকলে আমি নিজেই আমার পোশাক বর্ণনা দিয়ে ওকে রাজি করাই। সুখটুকু খুঁজে নিতে ক্ষতি কী?” কফিতে চুমুক দিয়ে মুচকি হেসে জানালেন কলকাতার এক নাম করা হাসপাতালের পদস্থ কর্মী লোপামুদ্রা সরকার।
কলেজ জীবনে পাঁচ বছরের সম্পর্কে ধাক্কা খেয়েছিলেন স্বাতী দত্ত। পুরোদস্তুর আবেগপ্রবণ স্বাতী ডিপ্রেশনে চলে যান। ধাক্কাটা এমনই লাগে যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে গিয়ে তিনি একের চেয়ে অধিক পুরুষের অ্যাটেনশন দাবি করে বসেন। বর্তমানে স্বাতীর ছ’জন ‘সেক্সটিং’ পার্টনার। কোনও কমিটমেন্ট বা সরাসরি যোগাযোগ না থাকায় স্বাতীর পক্ষে এটা চালানো সম্ভব হচ্ছে বলে জানালেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। স্বাতী তাঁরই ক্লায়েন্ট। ‘সেক্সটিং’ কিছুটা ক্ষতিও করছে বলে মানছেন তিনি।
মনোবিদ রঞ্জিতা বিশ্বাসের মতে, সেক্সটিং অন্য অনেক টার্মের মতোই একদম এই সময়ের একটা শব্দ। সেখানে ছবি শেয়ারিং বা সেক্সুয়াল কথাবার্তার মাধ্যমে একটি ছেলে বা মেয়ে সাময়িক যৌন আনন্দ খুঁজে নেয়। কিন্তু এতেই তো শেষ নয়। শারীরিক সম্পর্কের জন্য যখন আর সে ভাবে অপেক্ষা করতে হয় না এই প্রজন্মকে, সেখানে কেন সেক্সটিং? ভীষণ নবিশ মনে হয় না? “আসলে আমার কাছে কাউন্সেলিং-এ আসা ছেলেমেয়েদের দেখে মনে হয়েছে, এরা ওপেন স্মার্ট হলেও অন্যের সামনে নিজেকে খুলে ধরতে সময় নেয়। সেক্সটিং-এর ভারচুয়াল গ্যাপ নিজেকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। আবার অনেকে জানিয়েছে সেক্সটিং-এ যৌন ক্ষিদে মিটে যায়, তাই আর শারীরিক সম্পর্কের দিকে তারা উৎসাহ পায় না।” বললেন রঞ্জিতাদেবী।
মনোবিদ অনুত্তমা জানালেন আরও ভয়ঙ্কর দিকের কথা! তাঁর মতে, এই প্রজন্মের বহু ছেলেমেয়ে টাকার জন্য সেক্সটিং করে থাকে। স্কুল বা কলেজের পকেটমানিতে মদ বা আরও কোনও নেশার খিদে তো মেটে না, অনেক সময় সেটা পূরণের জন্য বা নিছকই টাকার লোভে ছেলেমেয়েরা বয়সে অনেকটা বড় কারও সঙ্গে ‘সেক্সটিং’ করতে আরম্ভ করে, যা থেকে বেরিয়েও আসতে পারে না। এটা কিন্তু বেশ চিন্তার। আর অপরাধের দিকটা? প্রেমিকার নগ্ন ছবি বাজারে বেচার জঘন্য মানসিকতা? অপর দিকের মানুষটি আদতে কেমন, তা-ও তো আপনি জানেন না। তার কাছে চলে যাওয়া কয়েকটা সুন্দর মুহূর্ত পরে আত্মহত্যার কারণ হবে না তো?
শুধু সেক্সটিং করার আগে আরও এক বার ভাবুন, শরীর শরীর তোমার মন নাই!
(সংগৃহীত)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন